দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চিকিৎসক সংকটে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম ব্যাহত চরম ভোগান্তিতে রোগীরা

আবুল হাশেম ফকির :

চিকিৎসক সংকটে ভেঙ্গে পড়েছে ঢাকার দোহার উপজেলার ৫০ শয্যা হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ৩০ জন চিকিৎসক হাসপাতালের রোগীদের সেবা দেয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৯ জন। ইমারজেন্সিতে আসা রোগী দেখতেই সময় পার হয়ে যায় বর্হিবিভাগে রোগী দেখার সময় পান না ডাক্তাররা। হাসপাতালে ইসিজি মেশিন থাকলেও অপারেটর না থাকায় রোগীদের দ্বিগুণ টাকা দিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে ইসিজি করাতে হয়। হাসপাতালের ডাক্তার থেকে শুরু করে রোগীদের নেই ভালো কোনো বসার মতো স্থান।

 

তাই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েই ইমারজেন্সিসহ সকল রোগীদের সেবা নিতে হচ্ছে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের। ফলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা হাজারো রোগীরা চিকিৎসা ব্যাবস্থা না পাওয়ার ফলে-সর্বশেষ ইমারজেন্সি অবস্থায় তাদের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে হয়। এদিকে অর্থোপেডিক, শিশু, মেডিসিন, নাক-কান-গলা, চর্মরোগ, চোখের ডাক্তার নেই যার ফলে বেশীরভাগ রোগী চিকিৎসা সেবা না পেয়ে নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। অপরদিকে, নামমাত্র একজন চিকিৎসক ও জরুরি বিভাগের একজন উপ-সহকারী চিকিৎসক দিয়ে আগত রোগীদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরা। ফলে বিস্তর সংখ্যক রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে কর্মরত চিকিৎসকদের। চিকিসৎসক সংকটের বিষয়টি নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও নেয়া হয় নি কোনো পদক্ষেপ। সরেজমিনে গত কয়েক দিনে দেখা যায়, গাইনি, নাক-কান গলা, অর্থোপেডিকসহ বিভিন্ন রোগের রোগীদের সেবা প্রদান করেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে থাকা ডিগ্রি প্রাপ্ত কিছু ডাক্তারের সহকারী। যাদের হালকা সেলাই বা ব্যান্ডেস করার চেয়ে আর কোনো চিকিৎসা প্রদানের দক্ষতা নেই। কিন্তু মূল চিকিৎসক না থাকায় তারাই এই সমস্ত রোগীদের প্রেসক্রিপশন করে ওষুধ লিখে দিচ্ছেন, যেখানে শুধুমাত্র বেথানাশক এন্টিবায়োটিক ছাড়া আর কোনো গ্রুপতত্ত্ব ওষুধ লিখার দক্ষতা নেই তাদের। এতে রোগীদের রোগ তো মুক্তিই পাচ্ছেই না বরংচ রোগীরা হচ্ছেন হয়রানির শিকার। হাসপাতালে ৩০ জনের মধ্যে ৯ জন চিকিৎসক থাকলেও নানা কারনে প্রতিনিয়ত হাসপাতালে সেবা প্রদানের সময়টুকুতেও চেম্বারে উপস্থিত থাকেন না চিকিৎসকরা। যার ফলে শুধু ভোগান্তিই নয় মানে হাসপাতালটি থাকলেও কাজের সময় চরম সংকটে দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
https://youtu.be/XXb8zMH6BE0
 

৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে দোহার উপজেলার প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষের সরকারি চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য এই ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও বর্তমান চিকিৎসক সংকটে প্রাপ্ত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা গ্রহন করতে আসা তিন থেকে চার’শ রোগী। যা গড় হিসাবে প্রতি মাসে রোগী সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় দশ হাজারো অধিক। তবে ৯ জন চিকিৎসক উপস্থিত থাকলেও তাদের মধ্যে থেকে ইউনানি, আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক পদে ১জন চিকিৎসক রয়েছেন যার কর্মস্থল ঢাকা ইএমও অফিসে। এর ফলে চিকিৎসক পদ শূন্যতার তালিকায়। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের এক জরিপে দেখা যায়, গত মাসে চিকিৎসা সেবা প্রদানসহ নানাদিক থেকে এগিয়ে হয়ে র‌্যাংকিং ০৬ তে উন্নীত হয়েছে দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে চিকিৎসকের অভাবে প্রতিনিয়ত রোগীরা হচ্ছে হয়রানির শিকার। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে নেই অপারেশনের রোগীকে অপারেশনের পূর্বে অজ্ঞান করার জন্য এনেস্থিসিয়া ডাক্তার, নেই শিশু বিশেষজ্ঞ, অর্থোপেডিক, কার্ডিওলোজী, চক্ষু, নাক-কান গলা, যৌন ও চর্ম, প্যাথলজিস্টসহ প্রায় ৮ জন চিকিৎসক! প্রতিদিন ডাক্তার চেম্বার খালি পড়ে থাকে যার ফলে উপরোক্ত বিভাগের রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারছে না দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তাছাড়া শুধু বর্হিবিভাগেই নয় হাসপাতালের ভেতরে ওয়ার্ডে ভর্তিকৃত রোগীদের সেবা প্রদানের জন্য নেই পর্যাপ্ত সিনিয়র স্টাফ নার্স। যেখানে সিনিয়র স্টাফ নার্স থাকার কথা ২৬ জন কিন্তু প্রকৃত পক্ষে যেখানে মাত্র ১৪ জন নার্স কর্মরত রয়েছেন! যার ফলে শুধু বহির্বিভাগেই নয় হাসপাতালের ওয়ার্ড ভিত্তিক ৫০ শয্যার মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রায় ৩০ শয্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থানকারী রোগীরা পাচ্ছে না সঠিক সেবা। তাছাড়া উপযুক্ত চিকিৎসক না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা সেবা চালানোর বিষয়টি স্বীকার করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসক না থাকায় সার্জারী বিভাগের রোগীদের জন্য পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন ক্লিনিকে ।
https://youtu.be/BxSo2aSroH0

কিন্তু পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় সার্জারী ও গাইনি বিভাগ এখনো তেমন পূর্ণাঙ্গরুপ ভাবে চালু করা সম্ভব হচ্ছেনা। গত সোমবার হাটু ব্যাথা জনিত কারনে উপজেলার নারিশা ইউনিয়ন থেকে আসা মজিবুর রহমান (৩২) নামে এক রোগী অর্থপেডিক্স ডাক্তারের খোঁজে হাসপাতালের কাউন্টার থেলে টিকেট কাটলে তাকে দেওয়া হয় হাসপাতালটির হরলাল নামে অন্য এক চিকিৎসককে। পরে ডা. হরলাল বিভিন্ন ওষুধ মজিবুর রহমানকে প্রস্তাব করলে মজিবুর রহমান সেই প্রস্তাব অনুযায়ী ওষুধ সেবন করেন। কিন্তু গত৭ জুলাই বৃহস্পতিবার তিনি আবারো হাসপাতালে আসেন ওই ডাক্তারকে দেখাতে যে তার ব্যাথা তো কমেইনি বরংচ আরো বৃদ্ধি পেয়ে তার হাটাচলা এখন বড় সমস্যায় পড়েছে। উপজেলার চর লটাখোলা থেকে আসা মরিয়ম (২৮) নামে এক সদ্য নবাগত সন্তানের মা জানান, গত ১ সপ্তাহ যাবত তার ছোট ছেলে শিশুটির ঠান্ডা আর কাশি। কিন্তু হাসপাতালে আসলে শিশু ডাক্তার না দেখিয়ে মেডিসিন ডাক্তার দেখানোর জন্য টিকিটে রুম নির্ধারন করা হয়। কিন্তু ঐ মেডিসিন ডাক্তারের ওষুধ সেবনের পরেও তার শিশু সন্তানটি রোগমুক্তি হচ্ছে না। তাই সে গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে সকাল ১০ টায় আসলেও সেই মেডিসিন ডাক্তার চেম্বারে এখনো এসে পৌঁছয়নি। যার ফলে সরকারি টাকায় এমন প্রতিষ্ঠানে সঠিক স্বাস্থ্য সেবা না পাওয়া গেলে এ সকল চিকিৎসক ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠান রেখে লাভ কি ? সরকারের কাছে এমন সব লাভ-লোকসানের প্রশ্ন রাখেন শিশু সন্তানের চিকিৎসক সেবা নিয়ে ভুক্তভোগী মরিয়ম আক্তার। বর্তমান সরকারের ইউনিয়ন ও এলাকাভিত্তিক সরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে এক অন্যতম উদ্যোগশীল স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী একটি সংস্থা সিএইচসিপি অর্থাৎ কমিউনিটি ক্লিনিক। এই সংস্থা থেকে ইউনিয়ন ও প্রতিটি এলাকা ভিত্তিক সকল জনগণের দৌড়গোড়ায় গিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ও পরামর্শ প্রদান করে সুস্থতা নিশ্চিত করনে কাজ করে থাকে। কিন্তু দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সাধীন কমিউনিটি ক্লিনিক সদস্য থাকা প্রয়োজন প্রায় ২৬ জন যেখানে কমর্রত আছেন মাত্র ১৫ জন সদস্য! চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানের অভাবে নষ্ট হচ্ছে লক্ষাধিক টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম। পাশাপাশি চালকের অভাবেও লক্ষ-লক্ষ টাকার একটি অ্যাম্বুলেন্স পড়ে রয়েছে জড়াজীর্ন অবস্থায়। হাসপাতালে এক্সরে, রক্ত, প্রসাব, ডায়াবেটিকস, জন্ডিসসহ নানান পরীক্ষন সেবা কাজ চিকিৎসক ও দক্ষ জনবল না থাকায় সঠিক মাত্রায় পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে হাতের নাগালে চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেবা বঞ্চিত হচ্ছে উপজেলার হাজারে মানুষ। গত এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষন করে দেখা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ পবিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জসিম উদ্দিনের রোগী দেখার কথা না থাকলেও রোগীর প্রবল চাপ ঠেকাতে তিনি প্রতিদিন ডাক্তার চেম্বারে বসে রোগী সেবা প্রদান করছেন। চিকিৎসা সেবার প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে রোগীরা ঝুকে পড়ছে পার্শ্ববর্তী ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। সেখানেও আবার নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অধিক টাকা আদায়ের ভোগান্তিতেও উপজেলা চিকিৎসা সেবা যেনো এখন ভয়ানক রূপ লাভ করেছে! বর্তমান বর্ষা মৌসুমে উপজেলার চরাঞ্চল থেকে স্বল্প আয়ের মানুষ বিনা খরচে সরকারি চিকিৎসা সেবা গ্রহন করতে চাইলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় তাদের সেবা দিতে অপারগ দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৮ টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬ টিতে সরকারি চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য সহকারী সার্জন চিকিৎসক থাকলেও নেই বিলাসপুর, মাহমুদপুর ও মালিকান্দাসহ ৩ টি ইউনিয়নে সহকারী সার্জন চিকিৎসক। তবে যে ৬ টি ইউনিয়নের সহকারী সার্জন আছেন তারা রোগী চাপ ঠেকাতে তাদের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে না গিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার চেম্বারে বসে রোগীদের সেবা প্রদানের চেষ্টা করছেন। যার ফলে ইউনিয়ন ভিত্তিক রোগীরাও এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে ভীড় জমাচ্ছে। এতে করে গোটা উপজেলা স্বাস্থ্য সেবা করুন অবস্থান্তরে বিরাজ করছে। নেই সঠিক পর্যায়ে ল্যাবরেটরিস্ট, ফার্মাসিস্ট, ই পি আই, কার্ডিওগ্রাফার, সহঃ স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও স্বাস্থ্য সহকারী। এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জসিম উদ্দিন জাগ্রত জনত্#া৩৯;কে জানান, পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় প্রতিদিন শত শত রোগীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা একটু সমস্যা হলেও খুব শীঘ্রই সরকারি নিয়ম নীতির মাধ্যমে শূন্য পদে ডাক্তার ও সার্জন চিকিৎসকদের স্থানান্তর করণের মাধ্যমে শূন্য পদ পুরণ করা হবে। বর্তমান সরকার চিকিৎসা খাতে বিশেষ নজড়দারিতায় চিকিৎসা সেবা আগেই চেয়ে আরও উন্নত হয়েছে। প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা তার কড়া নজড়দারিতা রয়েছে। খুব শীঘ্রই দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চিকিৎসক সংকট কাটিয়ে উঠবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যাক্ত করেন। উল্লেখ্য যে চলতি অর্থ বছরে সরকারিভাবে দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছিলেন ২৫ জন নিয়মিত চিকিৎসক। কিন্তু গত মে মাসের ২১ তারিখে সরকারি তলবে এই ২৫ জন চিকিৎসক থেকে ১৩ জন চিকিৎসক্#৩৯;কে এক যোগে বদলি করা হয়। পরে আরো কিছু চিকিৎসক সার্জনকে বিভিন্ন কারনে বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরের ফলে বর্তমানে ৯ জন চিকিৎসকে অবনতি হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তবে বদলিকৃত চিকিৎসকের শূন্য পদে গত জুন মাসের ৩ তারিখে কিছু নতুন চিকিৎসক প্রেরণ কথা থাকলেও সরকারিভাবে এখনো প্রেরণ কোনো চিকিৎসক করা হয়নি। তবে আর কতোদিন নাগাদ এমন সংকট পূরণের আশা বাস্তবে রূপ নেবে সেই দিনটি এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছেন ভুক্তভোগী রোগীরা।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment